অধ্যাপক নীহার কুমারের দৃষ্টিতে "ছোটদের রাজনীতি ও ছোটদের অর্থনীতি" এবং পর্যালোচনা

লেখক: মিনহাজুর রহমান রেজবী

"ছোটদের রাজনীতি ও ছোটদের অর্থনীতি" বইয়ের লেখক অধ্যাপক নীহার কুমার সরকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াবলীর ব্যাখ্যা করেছেন সুন্দরভাবে। ছোটদের রাজনীতি ও ছোটদের অর্থনীতি মূলত দুইটি গ্রন্থ কিন্তু বাজারের দুইটি গ্রন্থকে একটি বইয়ে সংযুক্ত করে বিক্রি করে বিধায়, আমিও দুইটি একই সাথে পড়েছি। আর সেই সুবাধে, আমি দুইটি গ্রন্থের একত্রে একটি পর্যালোচনায় নিয়ে এসেছি। কারণ, একই লেখকের ধারাবাহিক লেখা বলেই, এই সামান্য অন্যায় করা যায় বলে আমি মনে করি। প্রথম দিকে, আমি ছোটদের রাজনীতি অংশ এবং শেষে ছোটদের অর্থনীতি অংশের পর্যালোচনা করেছি।

লেখক রাজনীতির অংশের শুরুটা করেছেন পুঁজিবাদ বা ক্যাপিটালিজমের আলোচনা দিয়ে। লেখক ক্যাপিটালিজমের সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে বলেন, "যে সমাজে উৎপাদন যন্ত্রগুলি ব্যক্তিগত অধিকারে থাকে এবং যেখানে একমাত্র লাভের জন্যই পণ্য তৈরি হয়, সেই সমাজকেই আমরা ক্যাপিটালিস্ট সমাজ বলতে পারি"। ক্যাপিটালিস্ট সমাজে পণ্য তৈরি হয় লাভ করার জন্যই। লাভই ক্যাপিটালিজমের প্রধান কথা।

আর, ক্যাপিটালিজমের দুর্দশাকে বলা হয় ব্যবসা সংকট। ব্যবসা সংকট ও মানুষকে বেকার করে দেওয়া হলো ক্যাপিটালিজমের দ্বিতীয় ফল। যেমন, ১৯৩০-৩৩ সালে ভয়ঙ্কর ব্যবসা-সংকট হয়েছিলো। তাতে সমস্ত পৃথিবীতে কোটি কোটি লোক বেকার হয়ে গিয়েছিলো। লেখক ক্যাপিটালিজমের সমালোচনা করতে গিয়ে ক্যাপিটালিজমের বা পুঁজিবাদের পাঁচটি কুফলের কথা বলেছেন। যথা:

১) ব্যবসা সংকট তৈরি।

২) বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায় ব্যবসা সংকটের ফলে।

৩) উৎপাদন ক্ষমতার অপপ্রয়োগ। 

৪) গ্রামের সমাজ-ব্যবস্থা ও অর্থনীতি বা গ্রাম্য কুটির শিল্পের সর্বনাশ করে দেয়।

৫) যুদ্ধ; পুঁজিবাদীরা তাদের পুঁজির বিস্তার বাড়াতে যুদ্ধকে করে, যেমন-কলোনি দখল।

কলোনি না থাকলে ক্যাপিটালিজম বাঁচতে পারে না। ক্যাপিটালিস্টদের কেন কলোনি দরকার বা ক্যাপিটালিস্টরা সাম্রাজ্যবাদীর রূপ ধারণ করার কারণসমূহ লেখক সুন্দরভাবে আলোচনা করেছেন তার বইয়ে। সেইগুলো:

(১) ক্যাপিটালিস্ট দেশের কারখানাগুলোর জন্য খুব সস্তা দামে কলোনি থেকে কাঁচামাল পাওয়া যায়। সস্তা দামে কাঁচামাল পেলে পণ্য তৈরির খরচও কম এবং খরচ কম হলে লাভও বেশি করা যায়।

(২) কলোনিতে সস্তা দামের মজুর পাওয়া যায়, কারণ তাদের বেতন বা মজুরী কম দিয়া লাগে।

(৩) দেশে মূলধন খুব বেড়ে গেলে, নতুন ক্যাপিটাল বিনিয়োগ করার জন্য আর সুবিধা থাকে না। সেইজন্য ক্যাপিটালিস্ট দেশের গুলো নতুন কলোনি খুঁজে যেখানে ক্যাপিটাল বিনিয়োগ করে লাভজনক হওয়া যায়।

(৪) কলোনি থাকলে ক্যাপিটালিস্ট-দেশসমূহের লোকেরা কলোনিতে গিয়ে নানাভাবে আয় করতে পারে, যা বেকার সমস্যাও লাঘব করে।

(৫) কলোনি থাকলে দেশের শ্রমিকদেরও বশে রাখা যায়; শ্রমিকরা শোষিত হলেও বিপ্লব আনে।

লেখক সাম্রাজ্যবাদী দেশের সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন-"কোন ক্যাপিটালিস্ট দেশ যখনই উদ্বৃত্ত মাল বিক্রির জন্য, উদ্বৃত্ত ক্যাপিটাল খাটাবার জন্য, সস্তায় কাঁচামাল ও খাদ্যদ্রব্য কেনার জন্য, কোন পেছনে-পড়ে থাকা অ-ক্যাপিটালিস্ট দেশ দখল করে নেয়, তখন সেই দখলকারী দেশকে বলা হয়, সাম্রাজ্যবাদী দেশ"। সাম্রাজ্যবাদের প্রথম ও প্রধান কাজই হলো কলোনি নিজের দেশের মালপত্র বিক্রি করার জন্য বাজার হিসাবে ব্যবহার করা।

লেখক ফ্যাসিজমকে ক্যাপিটালিজমের নগ্ন রূপ বলেছেন। ফ্যাসিস্টরা ধনীক বা পুঁজিবাদী শ্রেণীর রক্ষক, যাকে লেখক ফ্যাসিজমের প্রথম কাজ বলেছেন। ইতালিতে প্রথম ফ্যাসিজমের যাত্রা শুরু হয়। ফ্যাসিজমে দ্বিতীয়  কাজ হলো কলোনি আদায় করা। কারণ, কলোনি না থাকলে ক্যাপিটালিজম বাঁচতে পারে না। ফ্যাসিবাদের ভয়ঙ্কর রূপ হলো হিটলারের নাৎসিবাদ। লেখক তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ন্যাৎসিবাদ শ্রমিকদের অধিকারের কথা বললেও পুঁজিবাদীদের স্বার্থের জন্য করেছে। যার কারণে, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ক্যাপিটালিস্টরাও হিটলারকে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিলো। দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধটা লেগেছিলো কলোনিহীন ফ্যাসিবাদীদের সাথে  কলোনিওয়ালা সাম্রাজ্যবাদী দেশের কারণ তাদের বেঁচে থাকার জন্য কলোনি দরকার। 

লেখক সমাজতন্ত্রবাদের প্রসার, শ্রেণী ও রাষ্টের দায়িত্ব ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সোশ্যালিজমের গোড়ার কথা- উৎপাদন যন্ত্রে সমাজের সকলের সমান অধিকার। আর কমিউনিজম কখন প্রতিষ্ঠা হওয়া এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গিয়ে লেখক বলেছেন- সোশ্যালিস্ট সমাজে থেকে থেকে সোশ্যালিস্ট শিক্ষার ফলে মানুষের মনে যথেষ্ট উন্নত হবে ও সমাজের স্বার্থ বড় করে দেখবে তখন। তবে বলে রাখা ভালো, কমিউনিজম হলো সোশ্যালিজমের উচ্চতর ধাপ যেখানে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে না। রাষ্ট্রের পরিবর্তে কমিউনিটির প্রয়োজনে ছোট ছোট 'জনসাধারণের কমিটি' থাকবে মাত্র।

অন্যদিকে, লেখক বইয়ে গণতন্ত্রের আলোচনা করতে গিয়ে, গণতন্ত্রকে দুইটি ভাগে বিভক্ত করেছে। যথা- বুর্জোয়া ডেমোক্রেসি বা ধনিকের গণতন্ত্র আর জনগণের গণতন্ত্র। ধনিকের গণতন্ত্র 'আইনের চোখের সবাই সমান বলে' কথা বললেও পুঁজিবাদীদের তাবেদার হিসাবেই কাজ করে। আর, জনগণের গণতন্ত্রকে লেখক উত্তম গণতন্ত্র বলেছেন।

সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিফলতার কারণ হিসাবে লেখক বইয়ে উল্লেখ করেছেন- পাতি বুর্জোয়াদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানসিকতা এবং লেনিন ও স্টালিন পরবর্তী যোগ্যতা নেতৃত্বের অভাব। কমিউনিস্টদের নৈতিক অধঃপতন ও পার্টির ভেতরের গণতান্ত্রিক নষ্ট হয়ে যাওয়া। তাছাড়া সোভিয়েতের অন্যান্য ভাষাভাষী ও জাতীদের প্রতি রাশিয়ানদের অবহেলা।

সাম্রাজ্যবাদীরা এখন সরাসরি কলোনি দখল না করে নতুন উপায়ের তাদের কর্তৃত্ব বিস্তার করতেছে, এই প্রক্রিয়াকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় নয়া সাম্রাজ্যবাদ। লেখকের মতে সেই নতুন উপায়গুলো হল:

ক. বহুজাতিক কোম্পানি এবং

খ. Aid বা সাহায্য

তাছাড়া, লেখক ছোটদের রাজনীতির অংশে মার্কিন যুদ্ধচক্র, জাতিসংঘ, সমাজতন্ত্রী বিপ্লবের যুগ, যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল, ভারতে জাতীয়তাবোধের উদ্ভব,জাতীয়তাবাদ, মৌলিকতাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা আঞ্চলিকতাবাদ, ফিউডালিজম, নাৎসিবাদ এবং নেশন বা জাতি কি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।

ছোটদের অর্থনীতি অংশে লেখক অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় যেমন উৎপাদন প্রণালী, উৎপাদন প্রণালীর ধরণ, পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালী, মূল্য, বিনিময় মাধ্যম বা টাকা, মজুরি, মুনাফা, সুদ এবং ব্যাংক ইত্যাদি নিয়ে সহজ ও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন।

এই অংশের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কার্যকরণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল "স্বল্প উন্নত" দেশসমূহকে উন্নয়নের নামের যে ঋণ দেয়, তা পরিশোধ করতে করতে বরং সেইসব দেশ ঋণের জালের আটকা পড়ে; ফলে, সেইসব দেশের আর উন্নয়ন সম্ভব হয়। 

লেখক খোলাবাজার নীতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, খোলাবাজার নীতি কারণ সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ বা পশ্চিমা ক্যাপিটালিস্টরাই বেশি লাভবান হয়েছে। আর, সাম্রাজ্যবাদীরা অনুন্নত দেশে তাদের পুঁজি নিয়োগ করে সেই দেশের উন্নতিসাধন করবে এটা অত্যন্ত দুরাশা। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো পুঁজি নিয়োগ করে কোন অনুন্নত দেশকে উন্নত করে তুলছে এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। বরং, পুঁজিবাদী দেশগুলো অনুন্নত দেশের নিয়োগ করে পুঁজি নিজ দেশে পাচার করে; তারা শুধু অনুন্নত দেশসমূহকে তাদের পণ্যের জমি হিসাবে ব্যবহার।

সর্বোপরি,  লেখক ছোটদের রাজনীতি ও ছোটদের অর্থনীতি দুই অংশে সুন্দর আলোচনা করেছেন; যারা প্রাথমিক ধারণা পেতে চায় তাদের জন্য উপকারী হবে বইটি। তবে, লেখকের আলোচনা একপাক্ষিক আলোচনা ছিলো, তিনি সমাজ্যতন্ত্র মতবাদকে উপজীব্য করে লিখেছেন। সমাজতন্ত্র বা সোভিয়েতের সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে বিশুদ্ধ শাসন ব্যবস্থা বা পদ্ধতি হিসাবে উপস্থাপন করেছেন কিন্তু তাদেরও যে সমালোচনা আছে যা বিশ্বের বিভিন্ন স্কলাররা বলেছেন ঐধরনের সমালোচনা লেখক এড়িয়ে গেছেন। আর এইটাই লেখকের দুর্বলতা। লেখক তার সমাজতন্ত্র নিয়ে আইডিয়ালিস্টিক (আদর্শিক) দিকটা উপস্থাপন করেছেন, বাস্তবতাকে এড়িয়ে গেছেন। অন্যদিকে, তিনি পুঁজিবাদ-তন্ত্রের বাস্তবতাকে ভালোভাবে উপস্থাপন করেছেন। মোটকথা, লেখক তার বইয়ে নিরপেক্ষ থাকতে পারেননি। 


লেখক পরিচিতিঃ মিনহাজুর রহমান রেজবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে  অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। তিনি উন্নয়ন অনুধ্যান ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। পাবলিক পলিসি, রাজনীতি ও উন্নয়ন অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা ও লেখালেখি তাঁর অন্যতম আগ্রহের জায়গা; এই বিষয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নাল ও ম্যাগাজিনে তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন। 

Post a Comment

0 Comments