ওয়াজ-মাহফিলের উঠতি জনপ্রিয়তা এবং তার প্রভাব



ছবি কৃতজ্ঞতাঃ দ্যা ডেইলি স্টার 
লেখকঃ রাফিদ আজাদ সৌমিক

 

সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। সংস্কৃতির সাথে অনেক সময় যোগ হয় অনেক প্রথা, আচার-আচরণ কিংবা অনুষ্ঠান, আবার মাঝে মধ্যে বাদও পড়ে অনেক কিছু। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ওয়াজ-মাহফিলের ব্যাপকতা এবং প্রচলন গ্রাম থেকে শহরে সবখানে বেড়েই চলছে। ওয়াজ-মাহফিলের এই ব্যাপকতা আমাদের সমাজের উপর কীরূপ প্রভাব ফেলছে, তা নিয়েই আজ আলোচনা করব।

ওয়াজ মাহফিলের সামাজিক-আইনী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করার আগে, ওয়াজ মাহফিল নিয়ে প্রাথমিক কিছু কথা বলে নেয়া যাক। ওয়াজ মাহফিল হলো মূলত এক ধরণের ইসলাম ধর্মীয় খুতবা অনুষ্ঠান যেখানে আলোচনায় ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়াদির পাশাপাশি স্থান পায় সামাজিক বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয়। এই বক্তব্যে স্থান পায় কোরান-হাদিসের ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে ধর্ষণ কিংবা করোনার মতো বিষয়গুলিও। আলোচনার এই ব্যাপকতার কারণেই হয়তো ওয়াজ-মাহফিলের জনপ্রিয়তা বর্তমানে ক্রমবর্ধমান। মাহফিলে বক্তব্য দেয়ার জন্য আমন্ত্রন জানানো হয় এক বা একাধিক বক্তাকে, এবং প্রিয় বক্তাদের শোনার  জন্য উপস্থিত হয় আগ্রহী জনতা। দর্শকদের মধ্যেও দেখা যায় বৈচিত্র্য। কেউ হয়তো তরুণ কেউ আবার বৃদ্ধ, কেউ হাজার হাজার টাকার মালিক, আবার কেউ দিনমজুরী। এই বৈচিত্র্যের দিকটিও ওয়াজ-মাহফিলের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।

আমাদের সমাজের উপর ওয়াজ-মাহফিলের প্রভাব বুঝার আগে আসলে বুঝতে হবে আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপট কেমন। প্রথমত, আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হলো ধর্মভীরু মুসলমান। অধিকাংশ সময় ওয়াজে আমন্ত্রিত প্রিয় বক্তাদের প্রতি থাকে ভক্তদের অগাধ আস্থা এবং অঢেল বিশ্বাস। দ্বিতীয়ত, আমরা যদি আমাদের আইন ব্যবস্থার দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব আমাদের আইনে ধর্মের একটি প্রভাব রয়েছে। আবার, সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার কারণে এবং আন্তর্জাতিক নানা চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টাও আমাদের আইনে লক্ষণীয়। ঠিক এই কারণে, একদিকে যেমন পেনাল কোড, ১৮৬০ এর ২৯৫(ক) ধারা অনুসারে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকে একটি  অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ ধারায় সব ধর্মের, বর্ণের, লিঙ্গের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। 

এবার চলে আসি ওয়াজ-মাহফিল আমাদের সমাজের সামাজিক-আইনী ব্যবস্থায় ঠিক কীরকম ভূমিকা পালন করে সেই প্রসঙ্গে। ওয়াজ-মাহফিল আমাদের সমাজে অনেকসময় ইতিবাচক ভূমিকা রাখে আবার অনেক সময় নেতিবাচক ভূমিকাও রাখে। প্রথমে ইতিবাচক কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক।

আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় মানুষের মাঝে নৈতিকতা সৃষ্টিতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজ। এর পেছনে আরও দায়ী আমাদের বিচার ও প্রশাসনিক বিভাগের দুর্বলতা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি। এর প্রভাবটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়- দেশের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই পা বাড়াচ্ছে অন্ধকারের দিকে এবং নিজেদের ক্ষতির পাশাপাশি সমাজেরও ক্ষতি করছে। ফলশ্রুতিতে, দেশে বেড়েই চলছে সন্ত্রাস, মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি কিংবা চুরি-ছিনতাই এর মতো অপরাধগুলি। এই ব্যাপারে অনেক সময় ওয়াজ-মাহফিল একটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। মাহফিলগুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সামাজিক এইসব অপরাধ নিয়ে আলোচনা করা এবং এই অপরাধগুলিকে ধর্মীয় আলোকে ব্যাখ্যা করা। যেহেতু, বাংলাদেশের একটি খুব বড় সংখ্যক মানুষ অত্যন্ত ধর্মভীরু, তাই ওয়াজ-মাহফিলে যখন এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন তা নৈতিকতার সেই অভাবটুকু মেটাতে সাহায্য করে। এইভাবে, নৈতিকতা সৃষ্টির মাধ্যমে ওয়াজ-মাহফিলগুলি অপরাধপ্রবণতা কমানোতে ভূমিকা রাখে।

এছাড়াও, ওয়াজ-মাহফিলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সামাজিক সংহতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখা। মাহফিলগুলিতে এক বিশাল জনসমাগমের সৃষ্টি হয়; আসে সব পেশা, শ্রেণি এবং বয়সের মানুষ। এই যে একজনের সাথে আরেকজনের সাক্ষাৎ হওয়া, এই ব্যাপারটি জনগণের মধ্যে একতা ও সহমর্মিতাবোধ সৃষ্টি করতে ভূমিকা রাখে, যা তাদের অনেক ক্ষেত্রেই বিপথে যাওয়ার পথ থেকে রক্ষা করে। আমরা জানি, অপরাধপ্রবণতা সৃষ্টির একটি বড় কারণ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করা। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ কমানোর মাধ্যমে অপরাধপ্রবণতা কমানোর ক্ষেত্রে অনেক সময় ওয়াজ-মাহফিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কিন্তু, এই মুদ্রার একটি ওপিঠ আছে। যেসব ক্ষেত্রে দেশের আইনের সাথে বক্তাদের মতের মিল আছে সেসব ক্ষেত্রে যদি এই ওয়াজ-মাহফিলগুলি একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে, তাহলে যখন দেশের আইনের সাথে এই বক্তাদের মতের অমিল দেখা দেয়, তখন এর প্রভাবটা কেমন হয়? কিংবা, যদি এই বক্তাদের বক্তব্যের এতই প্রভাব থাকে যে তা তরুণ-প্রজন্মকে অনেক ক্ষেত্রে বিপথে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে, তাহলে একজন অযোগ্য ব্যক্তি যদি বক্তা হয় তখন এর প্রভাব কিরূপ হয়? 

উত্তরটা খোঁজার জন্য একটি উদাহরণের দিকে নজর দেয়া যাক। আমাদের দেশের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ এর ধারা ২ অনুসারে ২১ বছরের নিচে কোনো পুরুষ কিংবা ১৮ বছরের নিচে কোনো নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না। এই আইন প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য হলো অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে ও মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য অধিকার নিশ্চিত করা এবং বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের শারীরিক নির্যাতন ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতা থেকে রক্ষা করা। বিশেষ করে, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের জন্য বাল্য বিবাহ একটি অভিশাপস্বরূপ। কিন্তু, এখনও অনেক ওয়াজ-মাহফিলে বক্তারা প্রকাশ্যে এই আইনের বিরোধিতা করে এবং এই আইন না মানার জন্য জনগণকে উৎসাহ দেয়। এর প্রভাব পরে সাধারণ সহজ-সরল মানুষদের মনে, যাদের কাছে মনে হতে থাকে বাল্য বিবাহ রোধ করা একটি ইসলাম বিরোধী চক্রান্ত। সরকারের ২০১৪ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী ৫৯% শতাংশ মেয়ের বিবাহ হয় ১৮ বছরের আগে। এই উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট হয়, যখন দেশের আইনের সাথে বক্তাদের মতের অমিল দেখা দেয় তখন তা কিভাবে দেশের আইন ও লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করে।  

এই উদাহারণের মতই যখন দেশে কার্যকরী আইনের সাথে বক্তাদের মতের অমিল দেখা দেয়,তখন মূলত তিন ধরণের সমস্যা দেখা যায়। প্রথমেই আসি বিভ্রান্তি ছড়ানোর ব্যাপারটিতে, যেটা সম্প্রতি করোনার সময় বিশেষভাবে আমাদের সবার নজরে এসেছে। আমরা দেখেছি বিভিন্ন ওয়াজে কিছু অযোগ্য বক্তারা দাবি করেন যে করোনা মুসলমানদের আক্রমণ করে না, ছোঁয়াচে রোগ বলে নাকি কিছু নেই, এমনকি এক বক্তা তো দাবি করেছেন যে তিনি স্বপ্নে করোনার ভ্যাক্সিন পেয়েছেন! এই কথাগুলো যে কতটা বানোয়াট এবং হাস্যকর তা আমরা অনেকে খুব সহজে বুঝতে পারলেও অনেক সহজ-সরল মানুষ এই বক্তাদেরকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার কারণে এই কথাগুলোকেও মনে প্রাণে বিশ্বাস করা শুরু করে। এর প্রভাবটিও ভয়াবহ। এখনও, দেশের অধিকাংশ মানুষ যখন এই মহামারী রোগ থেকে রেহাই পেতে চাচ্ছে, তখন বিভিন্ন ওয়াজে করোনার ভ্যাক্সিন না নিতে মানুষকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এই বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলি ছড়ানোর মাধ্যমে সহজ-সরল মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করেই ধর্ম ব্যবসা করে চলেছে কিছু মজিদ।

দ্বিতীয়ত আসে, বিদ্বেষ ছড়ানোর বিষয়টি, যেটি আরও বেশি ভয়াবহ। অনেক সময় আমরা দেখি অনেক অযোগ্য বক্তার বক্তব্যে ফুটে উঠে নারী ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষ এবং অত্যন্ত অবমাননাকর নানা কথা। অনেক সময় ওয়াজ মাহফিলগুলিতে নারীর অধিকার, নারীর উচ্চ শিক্ষা অর্জন, কিংবা চাকুরি করতে দেয়ার ব্যাপারগুলিকে সরাসরি নিরুৎসাহিত করা হয়, যা সরাসরি দেশের নারী অধিকারয়নের পথটিকে আরও কঠিন করে তুলে এবং বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮, ২৯ ও ৪০ নং ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিকতা সৃষ্টি করে। এছাড়াও অনেক সময় দেখা যায় অনেক বক্তাকে বাল্য-বিবাহ, নারীর উপর হাত তুলা, কিংবা অমুসলিমদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির ব্যাপারগুলিকে উৎসাহিত করতে। এর পেছনে মূল কারণ বক্তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা এবং অজ্ঞতা।

সবশেষে আসি, কীভাবে মাঝে মধ্যে ওয়াজ-মাহফিলগুলির বক্তব্য দেশের সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলাকেও ব্যাহত করে- সেই বিষয়ে। দেশের একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকার পরেও, অনেক সময় দেশের আইন ব্যবস্থার উপর আস্থা না রাখতে বলে, বক্তারা উপস্থিত জনগণকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উৎসাহ দেয়। অনেক সময় এই ধরণের বক্তব্য পেনাল কোডের ১৫৩ ও ১৫৩(ক) নং ধারার সাথে সাংঘর্ষিক হয়। বিশেষ করে, কারও নামে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এলে তার বিরুদ্ধে উৎসুক জনগনকে আরও বেশি প্ররোচিত করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এর প্রভাবটাও কিন্তু খুব ভয়াবহ। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রচুর ব্লগার, লেখক, সম্পাদক এবং মানবাধিকার কর্মীর উপর চলেছে নৃশংস হামলা, আঘাত করা হয়েছে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং অভিজিৎ রায় এর মতো জনপ্রিয় ও জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকেও। মাঝেমধ্যেই দেখা যায় বিভিন্ন ব্যক্তির উপর আক্রমণের হুমকি দেয়া হয় এইসব বক্তব্যের মাঝে। এর মাধ্যমে ক্রমশই আমাদের সমাজ আরও  ধর্মান্ধ, গোঁড়া এবং অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, যা কোনোভাবেই আমাদের সমাজের জন্য ভালো সংবাদ না।

ওয়াজ-মাহফিলের নেতিবাচক দিকগুলির কারণে যে ওয়াজ-মাহফিল পুরো ব্যাপারটাই খারাপ হয়ে যায়- বিষয়টি কিন্তু মোটেও তা না। আগেই বলা হয়েছে, আমাদের সমাজে ওয়াজ-মাহফিলের অনেক তাৎপর্য ও ইতিবাচক দিকও রয়েছে। কিন্তু, অনেক সময় যখন অযোগ্য বক্তারা তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে সমাজের ক্ষতিসাধন করে কিংবা দেশের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে, তখন আমাদের প্রশাসনের দায়িত্ব হলো কঠোরভাবে এই ধরণের বক্তব্যের ও বক্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য, সচরাচর এইসব ক্ষেত্রে আমাদের প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। এই ধরণের বক্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে বেড়েই চলছে বিদ্বেষমূলক ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য, এবং এই ধরণের অযোগ্য বক্তাদের সংখ্যা। আমাদের সমাজও ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে আরও বেশি অসহিষ্ণু ও গোঁড়া। এই বিষয়টি সমাধান করার জন্য প্রয়োজন প্রশাসনের সৎ সাহস ও সদিচ্ছা।  কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে?


লেখক পরিচিতিঃ

রাফিদ আজাদ সৌমিক একজন উঠতি গবেষক ও লেখক।

Post a Comment

0 Comments